Saturday, May 20, 2017

ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে?

ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে?
আমি অহন রিস্কা চালাই ঢাহা শহরে।
 অথবা 

 আমি যে রিস্কাওয়ালা, 
দিন কি এমন যাবে?
বলি গো ও মাধবী
তুমি কি আমার হবে?   

এই গানগুলো অনেকেরই শোনা। এই দুটিগানের অন্যতম মিলের জায়গা হল রিক্সা এবং রিক্সা চালকের জীবনের কথা। রিক্সা নিয়ে এমন রোমান্টিকতা বোধহয় শুধু বাংলাতেই মেলে।  

বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের মানুষের সাথে দিন দিন ধরে চলে আসা এক বাহন হচ্ছে এই রিক্সা। যদিও এই বাহন এশিয়ার অনেক জায়গাতেই দেখা যায় এবং যেত। এমনকি এশিয়ার বাইরে আফ্রিকা, ইউরোপ সহ অনেক দেশেই দেখা যেত এই বাহন। ১৮৬৯ সালের এই জাপানি আবিষ্কার এখনও নানান ফর্মে দেখা যায়। হাতে টানা রিক্সার প্রচলন থাকলেও হালের প্যাডেল-চেইন রিক্সাওয়ালাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব করেছে। কলকাতা সহ আরও কিছু জায়গায় আজও টানা রিক্সা দেখা গেলেও বাংলাদেশে প্যাডেল রিক্সার (সাইকেল রিক্সার) প্রাধান্যই বেশি। জাপানে এখনও কিছু টানা রিক্সা দেখা যায় যা সেদেশের পর্যটকদের জন্য সুভেন্যিয়ের হিসেবে চালু আছে। তবে যেখানে আমাদের রিক্সা একদমই আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান তা হল রিক্সার গায়ের উপরে আঁকা নকশা। 

রিক্সার এই নকশা কালক্রমে বিভিন্নভাবে নানান আঙ্গিক পেয়েছে এবং চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে। যেমন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রিক্সার পেছনে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে ঠিক তেমনি প্রকাশ পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা। অধুনা রিক্সার নকশাতে সমকালীন বিষয়ে প্রাধান্য কিছুটা কমেছে বৈকি তবে হারিয়ে যায়নি সমসাময়িকতা। 



সাধারণত রিক্সার নকশাতে দেখা যায় সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের, গ্রাম ও শহরের দৃশ্য, ফুল-পাতার মটিফ। দেখা যায় বিভিন্ন স্থাপনাও; যেমন: স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার। প্রেমের মহার কীর্তি তাজমহলও চোখে পড়ে। এছাড়াও দেখা যায় 'মায়ের দোয়া' লেখা কারুকাজ



মায়ের দোয়া  রিক্সার নকশাতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাবলা নামের এক রিক্সা কারিগর বলেন যেতার পছন্দের বিষয় হল 'মায়ের দোয়াএবং তিনি মনে করেন যে এই লেখাটি কোন রিক্সার গায়ে থাকলে যাত্রী এবং চালক দুজনেই মায়ের দোয়ায় নিরাপদ থাকবেন এবং এই কল্যাণে আয়ও বেশ ভাল হবে। এমন ধারণা অনেক রিক্সা নকশাকারীদের মধ্যে দেখা যায়। অনেকে এর সাথে বাবা-মায়ের দোয়া কথাটাও লিখে থাকেন। শুধু 'মায়ের দোয়ানয় বড় করে 'মালেখাও চোখে পড়ে। 





এছাড়াও সাঁটানো থাকে নানা ধরণের বিজ্ঞাপন; যেমন: কোচিং সেন্টার বা কোন ব্যাঙের ছাতা মার্কা ইন্সটিটিউট। অনেক রিক্সার পেছনের দিকের টিনে আবার দেখা যায় জনসচেতনতামূলক বানী। এইডস রোগের বিষয়ে সাবধানবানী সংবলিত একটা টিন চোখে পড়েছিল একবার। 

আবার কিছু রিক্সাতে দেখা যায় 'আল্লা মহান' বা 'আল্লাহ মহান'আবার দেখা যায় কোন ফকির বা আউলিয়ার নাম। একটি রিক্সার হুডের উপরে একবার নকশা করে লেখা ছিল, 'মোহছেন আউলিয়া'হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক রিকশাওয়ালার রিক্সাতে 'ওঁ' দেখতে পাওয়া যায়, তবে তার সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। সৃস্টিকর্তার নামের ব্যবহারে অঞ্চলভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। যেমন পীর- আউলিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে তাদের নামাঙ্কিত নকশা দেখা যায়, যা কিনা অন্যান্য অঞ্চলে ততটা দেখা যায় না।  



রিক্সার নকশাতে স্থান হয় রুপালী পর্দার মানুষদের স্থান চিরন্তনসিনেমার কোন একটি বিশেষ মুহূর্ত, যা কিনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিনেমার শেষ দৃশ্যের মারামারি। সিটের গায়ে বা পেছনের টিনের প্লেটে পাওয়া যায় তাদের 'রঙিন' মুখ। গাঢ় রঙের ব্যবহার লক্ষণীয়। নায়ক-নায়িকার মুখ আঁকলে পরে রঙ গাঢ় কইরা দিতে হয়, নাইলে পরে তাগো ব্যাপারডা থায়ে না। আর ফাইট সিনে হেগোরে পুরুষ মাইনসের লাহান না লাগলে হইব!’উল্লেখ্য যে, রিক্সার নকশাতে নায়কদের অতিরিক্ত ম্যাস্কিউলিন করে তোলার ব্যাপারটা দেখা যায়। আবার অন্যদিকে নায়িকাদের স্ফীত দেহভঙ্গিও লক্ষ্যনীয়।



তবে অনেক রিক্সা নকশাকারি কারও মুখাবয়ব আঁকতে চান না। এমনই এক নকশাকারি হলেন মোহম্মদ আলী। তিনি মনে করেন যে রিক্সায় কোন জীবিত বা মৃত মানুষের মুখ আঁকা একধরণের পাপ। তিনি এও মনে করিয়ে দেন যে এই কাজ ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। 

অনেকে আবার পছন্দ করেন শহরের দৃশ্য আঁকতে। অনেকে আবার মজে থাকেন গ্রামের ছবিতে। কিছু কিছু রিক্সাতে আবার অনেক ক্ষেত্রে রঙের প্রলেপ না থাকলেও কাপড় ডিজাইন করে কেটে নানান মটিফ তৈরী করা হয়। 



আবার বেশ কিছু রিক্সাতে দেখা মেলে রিক্সা মালিক বা কারিগরের ফোন নাম্বার সহ নাম। উল্লেখ্য বিষয় যে, রিক্সা তৈরির কারিগরেরা তাদের নাম বেশ জাঁকিয়ে লিখে রাখেন রিক্সার গায়ে। শুধু রিক্সার গায়েই নয় বরং পা রাখার জায়গাটাতেও রয়েছে নকশা। 

রিক্সার এই নকশাগুলোতে মিশে থাকে কারিগরের জীবনের কথাই। তাদের জীবন সংগ্রামের কথা উঠে আসে তাদের কাজের ভিতর দিয়ে। এই কাজগুলো পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের চিন্তা জগতের সাথে, তাদের আকাঙ্ক্ষার সাথে। শহরের দৃশ্য আঁকা লোকটি এই ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে খুঁজে পেতে চায় তার মাথা গোঁজার ঠাই। অন্যদিকে গ্রামের দৃশ্যের শিল্পীর মন টানে তার দেশে ফেলে আসা পরিবারের জন্য। দেশের নানান প্রান্ত থেকে এসে জমা হয় নগরের কেন্দ্রে। পাশবিক এই শহুরে জীবনের মাঝেও তারা খুঁজে পেতে চায় জীবনকে।

রিক্সার নকশাকে শুধুমাত্র নকশা বললে ভুল হবে। এটি আসলে এক প্রকার প্রকাশ মাধ্যম। একেও শিল্পের আঙ্গিনায় ফেলা যায়। হয়ত কুলীন বংশের খেতাব মিলবে না কিন্তু 'আর্ট ফর আর্ট সেক'- এমন জায়গা থেকেও তাকে রাখা যেতেই পারে। এই প্রকাশ কারিগরের জীবনের। এই ক্যানভাসেই তারা রচনা করে তাদের আনন্দ-বেদনার কাব্য। 



কিন্তু সেই কাব্যের দাম তো মেলে না। ছোটলোকের শিল্প হয়েই থাকতে হচ্ছে। বুর্জোয়া সমাজে তার স্থান হচ্ছে পয়সাপতিদের বসার ঘরে। চারপাশে দামী ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। কারও ঘরের পেরেকে ঝুলে থাকে রিক্সার নক্সা অলংকৃত টিন। অনেকে আবার নিজেদের ঘরের দেয়াল, আসবাব সাজান এই নকশাতে। রিক্সার এই নকশা এখন তাই বড়লোক আর মধ্যবিত্তের ঘরের শোভাবর্ধনকারী দ্রব্য মাত্র। কিন্তু এতে করে কি পূর্ণ মর্যাদা পেল এই শিল্পিরা? নিজেরা সেই আধপেটাই থেকে যাচ্ছেন। তাদের ঘরে এখনো কান্নার রোল। তাদের বেঁচে থাকার সম্বল এখন রিক্সা আর্টনামে বিশ্বময় ঘুরছে তার তাদের ভাগ্যের চাকা এখনও একচুলও নড়ল না।





Friday, May 5, 2017

গরুড় স্তম্ভ এবং হরগৌরি মন্দির

নওগাঁ জেলার জাহানপুর ইউনিয়ন। ডাকঘর মঙ্গলবাড়ি। নিজের কোন কাজে নয় বরং আরেকজনের কাজের সূত্রধরে এখানে আসা। যার সাথে আসা, তিনি সম্পর্কে আমার বড় ভাই। তার কাজের জন্য বেশ কয়েকবার এখানে এসেছেন। তবে তার মঙ্গলবাড়ি আসবার সংখ্যাটাকে 'বেশ কয়েকবার' এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না! কাজের জায়গাটা জাহানপুরে হলেও রাতে বেলা ঘুমানোর জন্য বেছে নিয়েছিলাম জয়পুরহাটকেই। তাই প্রতিদিনই যাওয়া-আসা করতে হত আমাদের।

ঢাকা থেকে বাসে করে জয়পুরহাট। রাতের বেলা রওনা দিয়ে পৌঁছলাম একবারে ভোরের দিকে। সেখানের স্থানীয় এক সংস্থার গেস্টরুমে উঠলাম আমরা। উত্তরের উষ্ণ সন্তান হলেও জয়পুরহাটের আবহাওয়ার শীতলভাব (তাও আবার এপিলের দিকে) আমাকে বিস্মিত করেছিল। তবে এই আবহাওয়ার কারণেই আরামে কাজ করা গেছে। প্রাতরাশ সেরেই রওনা দিলাম মঙ্গলবাড়ির দিকে, তবে কীভাবে যাব তা নিয়ে বেশ হ্যাপায় পড়া গেল! কারণ, যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় বাসে ছিল 'অতিরিক্ত' উপচে পড়া ভিড়। আবার অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত একপ্রকার যান (অটো), যাতে চড়া নিয়ে আমরা দুজন দোমনা করছিলাম। তবে শেষমেশ একটা বাসেই আমাদের গতি হল। দৌড়-ঝাপ করে ওঠার পরে ভাগ্যবশত দুটো সিটও পেয়ে গেলাম। বাসটি প্রায় এক অসম্ভব গতিতে দৌড়ে আধা ঘন্টায় আমাদের মঙ্গলবাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল।

আমাদের দুই ভায়েরই চায়ের বড় নেশা! তাই নেমেই ছুট লাগালাম বাজারের ভিতরের দিকে। রাস্তার দুধারে অনেক দোকান থাকলেও কেন যে ওই দোকানেই চা খেতে গিয়েছিলাম তা বুঝছিলাম চা-টা খাবার পরেই। চায়ের পালা সাঙ্গ করে কিছু সরকারি অফিসে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিলাম।
এই সেই চায়ের দোকান। এই হাঁড়িতেই দুধ জ্বাল দেয়া হয়। ভালো গরুর দুধের চা খাওয়ার ভাগ্য হলেও এমন সৌভাগ্য হয় নাই 



হরগৌরি মন্দির ও ভীমের পান্টি:  

এবারে আর কাজের তাড়া নেই তাই হাঁটতে থাকলাম গাঁয়ের পথ ধরেই। গাঁয়ের পথ বললে যে ধরণের র‍্যোমান্স কাজ করে তার অনেকটাই হয়ত কমে যায় পিচগলা রাস্তা পেলে। তবে কিছুদূর গিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে ব্যাটারিচালিত ভ্যানের শরণাপন্ন হলাম। এসে এমন এক জায়গায় নামলাম যেখান থেকে বামের দিকে একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে। দূর থেকেই একটা উঁচু মতন জায়গা চোখে পড়ে। গা জুড়ানো মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালাম এক সিঁড়ির গোঁড়ায়। কাছে গিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে দেখালাম একটা মন্দির; মন্দিরের গায়ে বড় করে লেখা 'ঐতিহাসিক শ্রী শ্রী হরগৌরি মন্দির'। এই মন্দিরের আদি স্থাপনাকে ঘিরে এক ধুম্রজাল রয়েছে আদি মন্দিরটি হিন্দু না বৌদ্ধ মন্দির ছিল এই নিয়ে। তবে পাশেই রয়েছে একটি অতি প্রাচীন বৃক্ষ যে কিনা পরম আদরে জড়িয়ে রেখেছে মন্দিরের আদি স্থাপনার ইটগুলোকে। প্রাচীন মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষের উপরেই নতুন মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। মন্দিরে হরগৌরির প্রতিমার পাশাপাশি একটি শিব মন্দির এবং একটি কালী প্রতিমাও রয়েছে।

শ্রী শ্রী হরগৌরি মন্দির
মন্দিরের পেছনের দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে কয়েক কদম (১৫০ মিটার দক্ষিণে) হাঁটলেই গরুড় (বিষ্ণুর বাহন) স্তম্ভ, যা কিনা ভীমের পান্টি (ভীব দেবের পান্টি) নামে পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষায় পান্টি বলতে বোঝায় গরু চরানোর কাজে রাখালের ব্যবহৃত লাঠি। এই নাম নিয়ে এক লোককথা প্রচলিত আছে: পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে মানুষের ধারণা জন্মে যে, দেবদূত ভীম মর্ত্যলোকের ভূমি কর্ষনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। গভীর রজনীতে চাষ কার্য শেষে মঙ্গলবাড়ী এসে ভোর হয়। তিনি দ্রুত লোক চক্ষুর অন্তরালে স্বর্গে গমনকালে তাঁর হাতে থাকা পান্টিটি আপন ভারে মাতিতে পুঁতে যায়।

তবে অন্য মতও দেখতে পাওয়া যায়:
"অবশ্য ভীম নামের সাথে একটি ঐতিহাসিক যোগসুত্র রয়েছে। একাদশ শতকে পাল রাজত্বের অধঃপতনের যুগে দ্বিতীয় মহীপালের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এক গণ বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন স্থানীয় কৈবর্ত নায়ক দিব্যোক। তিনি দিবর দিঘীতে প্রতিষ্ঠিত দিব্যোক স্মৃতি স্তম্ভের (দিবরদীঘি) নিকটবর্তী স্থানে মহীপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিব্যোকের ভ্রাতুস্পুত্র ভীম জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। তাঁরই স্মৃতি দেবদূত ভীমের অলৌকিক শক্তিকে হয়তো আচ্ছন্ন করেছে। প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ হিন্দু ধর্মানুরাগী ছিলেন। এখানে হরগৌরির যুগল স্বর্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং খিষ্ট্র পূর্ব দ্বিতীয় শতকের শিবলিঙ্গের অনুরূপ একটি বিগ্রহের আরধনা করত এখানকার মানুষ। সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এই ধর্মীয় অনুভূতির কেন্দ্রে এক সময় আবিস্কার করে মঙ্গলজলের। এখানকার একটি জলাশয় থেকে সকল প্রকার রোগ শোকের মুক্তি লাভের আশায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ মঙ্গলবার দিন ভীড় জমাতো। সেখান থেকেই মঙ্গল বারির মহিমায় মঙ্গলবাড়ী হাটে রূপান্তরিত হয়েছে। "

ভীমের পান্টি মূলত নারায়ন পালের মন্ত্রী গুরব মিশ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৭৮০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাদাল কুঠির অধ্যক্ষ স্যার চার্লস উইকিন্সন ২৮ পঙতির দীর্ঘলিপি বিশিষ্ট এই স্তম্ভটি অবিস্কার করেন। এর লিপির নাম- প্রত্নবাংলা, যা কিনা আমাদের বাংলা লিপির পূর্বপুরুষ। লিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হয় যে এই স্থানটিকে গুড়ব মিশ্র এবং তার পরিবারের আবাসস্থল ছিল। এ পরিবারটি বংশানুক্রমিকভাবে পালদের মন্ত্রী ছিল।

স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা লিপি- প্রত্নবাংলা। 
পাল নৃপতি নারায়ন পালের শাসনামলে (৮৫৪-৯০৮ খ্রী) তার মন্ত্রী গুরব মিশ্র এই স্তুতিবাক্য খোচিত স্তম্ভটির প্রতিষ্ঠা করেন। এতে রাজা নারায়নের পিতা কেদার মিশ্র, পিতামহ সোমেশ্বর পাল, প্রপিতামহ দর্ভপাণি, প্র-প্র-পিতামহ গর্গের সম্পর্কেও প্রশস্তি আছে এই স্তম্ভে। গুরব মিশ্র নারায়ন পালের, কেদার মিশ্র সূরপাল ও দেবপালের, দর্ভপাণি দেবপালের এবং গর্গ ধর্মপালের মন্ত্রী ছিলেন বলে লিপিতে উল্লেখ আছে।

লিপি: প্রত্নবাংলা 


ব্ল্যাক ব্যস্যল্ট (Black Basalt) বা কৃষ্ণাভ ধূসর প্রস্তরে নির্মিত এই স্তম্ভ প্রায় ৩.৬ মিটার উঁচু এবং পরিধি প্রায় ১.৭৬মিটার। তবে আগে এটি আরও উঁচু ছিল বলেই ধরনা করা হয়। কিন্তু খোলা প্রান্তরে স্থাপিত হওয়ায় এটি সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হওয়ায় চূড়ার উপরে স্থাপিত গরুড় মূর্তিসহ উপরের অংশ ভেঙ্গে গেছে। স্তম্ভের গোড়ার দিকে পাপড়ি নকশা দেয়া রয়েছে। স্তম্ভের চারপাশে একটি বাঁধানো বেদী রয়েছে। স্তম্ভের গায়ে বজ্রলেপ ছিল তবে অনেকাংশে উঠে গেলেও স্তম্ভটি এখনও মসৃণ রয়েছে। উল্লেখ্য যে, স্তম্ভের গায়ে H. Creisten 1986 লেখাটি খোদাই করা রয়েছে। এছাড়াও NAT 1943 সহ আরও কয়েকটি খোদাই পাওয়া যায়। তবে এর সঠিক হদিস এখনও অজানা।

ভীমের পান্টি/ ভীম দেবের পান্টি/ গরুড় স্তম্ভ

গরুড় স্তম্ভের লিপি থেকেই অনুমিত হয় যে মঙ্গলবাড়িতে ব্রাহ্মণ কেদার মিশ্র- গুড়ব মিশ্র সহ আরও অনেক পাল মন্ত্রীদের নিবাস ছিল। এই ধারনার উপরে ভিত্তি করে পালরাজ নারায়ন পালের বাসস্থান আমাইর/ আমৈর (রামাবতী) বলে মনে করেন। অনেক গবেষকের মতে খুব সম্ভবত গুড়ব মিশ্রের আবাসভবন ছিল স্তম্ভের উত্তর দিকে অর্থাৎ মঙ্গলবাড়ি বাজারের নিকটবর্তী কোন স্থানে।  

তবে এই সকল তথ্য নিয়ে রয়েছে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক। সেখানে পুরানো স্তম্ভটি থাকলেও আশেপাশে কোথাও কোন পুরাতন ভবনের ধ্বংসাবশেষ নেই। সেক্ষেত্রে বলতে হয় যে, মন্দির থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানেই (খুব সম্ভবত বিলের মধ্যে) এই স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছিল। 

তবে এখন আর সেই বিল নেই চারদিকে সবুজের সমারোহে রয়েছে ফসলের খেত। আর এর মাঝেই শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে বিরাজমান মন্দির, যার বৃক্ষশোভিত প্রাঙ্গন থেকেই চোখে পড়ে প্রায় কয়েকশত বছর আগের ইতিহাসের সাক্ষী গরুড় স্তম্ভ।
     


কৃতজ্ঞতা:

  • বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ- আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া 
  • প্রত্ননগর মাহীসন্তোষ: উদ্ভব, বিকাশ ও পরিনতি- মোঃ রেজাউল করিম, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ। 
  • ধামইরহাট উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা- প্রফেসর মোঃ শহীদুল ইসলাম, ধামইরহাট এম.এম. ডিগ্রী কলেজ, নওগাঁ।
  • সাদিয়া বুশরা