ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে?
আমি অহন রিস্কা চালাই ঢাহা শহরে।
অথবা
আমি যে রিস্কাওয়ালা,
দিন
কি এমন যাবে?
বলি গো ও মাধবী
বলি গো ও মাধবী
তুমি
কি আমার হবে?
এই গানগুলো অনেকেরই শোনা।
এই দুটিগানের অন্যতম মিলের জায়গা হল রিক্সা এবং রিক্সা চালকের জীবনের কথা। রিক্সা
নিয়ে এমন রোমান্টিকতা বোধহয় শুধু বাংলাতেই মেলে।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিম
বঙ্গের মানুষের সাথে দিন দিন ধরে চলে আসা এক বাহন হচ্ছে এই রিক্সা। যদিও এই বাহন
এশিয়ার অনেক জায়গাতেই দেখা যায় এবং যেত। এমনকি এশিয়ার বাইরে আফ্রিকা, ইউরোপ সহ অনেক দেশেই
দেখা যেত এই বাহন। ১৮৬৯ সালের এই জাপানি আবিষ্কার এখনও নানান ফর্মে দেখা যায়। হাতে টানা রিক্সার প্রচলন থাকলেও হালের
প্যাডেল-চেইন রিক্সাওয়ালাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব করেছে। কলকাতা সহ আরও কিছু জায়গায়
আজও টানা রিক্সা দেখা গেলেও বাংলাদেশে প্যাডেল রিক্সার (সাইকেল রিক্সার)
প্রাধান্যই বেশি। জাপানে এখনও কিছু টানা রিক্সা দেখা যায় যা সেদেশের পর্যটকদের
জন্য সুভেন্যিয়ের হিসেবে চালু আছে। তবে যেখানে আমাদের রিক্সা একদমই আলাদা
বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান তা হল রিক্সার গায়ের উপরে আঁকা নকশা।
রিক্সার এই নকশা কালক্রমে
বিভিন্নভাবে নানান আঙ্গিক পেয়েছে এবং চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বকতার
সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে। যেমন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রিক্সার
পেছনে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে ঠিক তেমনি প্রকাশ পেয়েছে
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা। অধুনা রিক্সার নকশাতে সমকালীন বিষয়ে প্রাধান্য
কিছুটা কমেছে বৈকি তবে হারিয়ে যায়নি সমসাময়িকতা।
সাধারণত রিক্সার নকশাতে
দেখা যায় সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের,
গ্রাম ও শহরের দৃশ্য, ফুল-পাতার মটিফ।
দেখা যায় বিভিন্ন স্থাপনাও; যেমন: স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার। প্রেমের মহার কীর্তি তাজমহলও চোখে পড়ে। এছাড়াও দেখা যায় 'মায়ের দোয়া' লেখা কারুকাজ।
মায়ের দোয়া রিক্সার নকশাতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাবলা নামের এক রিক্সা কারিগর বলেন যে, তার পছন্দের বিষয় হল 'মায়ের দোয়া' এবং তিনি মনে করেন যে এই লেখাটি কোন রিক্সার গায়ে থাকলে যাত্রী এবং চালক দুজনেই মায়ের দোয়ায় নিরাপদ থাকবেন এবং এই কল্যাণে আয়ও বেশ ভাল হবে। এমন ধারণা অনেক রিক্সা নকশাকারীদের মধ্যে দেখা যায়। অনেকে এর সাথে বাবা-মায়ের দোয়া কথাটাও লিখে থাকেন। শুধু 'মায়ের দোয়া' নয় বড় করে 'মা' লেখাও চোখে পড়ে।
এছাড়াও সাঁটানো থাকে নানা ধরণের
বিজ্ঞাপন; যেমন: কোচিং
সেন্টার বা কোন ব্যাঙের ছাতা মার্কা ইন্সটিটিউট। অনেক রিক্সার পেছনের দিকের টিনে
আবার দেখা যায় জনসচেতনতামূলক বানী। এইডস রোগের বিষয়ে সাবধানবানী সংবলিত একটা টিন
চোখে পড়েছিল একবার।
আবার কিছু রিক্সাতে দেখা যায় 'আল্লা মহান' বা
'আল্লাহ মহান'। আবার দেখা যায় কোন ফকির বা আউলিয়ার নাম। একটি রিক্সার
হুডের উপরে একবার নকশা করে লেখা ছিল, 'মোহছেন আউলিয়া'। হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক রিকশাওয়ালার রিক্সাতে 'ওঁ' দেখতে
পাওয়া যায়, তবে তার সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। সৃস্টিকর্তার
নামের ব্যবহারে অঞ্চলভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। যেমন পীর- আউলিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে তাদের নামাঙ্কিত নকশা দেখা যায়,
যা কিনা অন্যান্য অঞ্চলে ততটা দেখা যায় না।
রিক্সার নকশাতে স্থান হয় রুপালী
পর্দার মানুষদের স্থান চিরন্তন। সিনেমার কোন একটি বিশেষ মুহূর্ত, যা কিনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিনেমার
শেষ দৃশ্যের মারামারি। সিটের গায়ে বা পেছনের টিনের প্লেটে পাওয়া যায় তাদের 'রঙিন' মুখ। গাঢ় রঙের ব্যবহার লক্ষণীয়। ‘নায়ক-নায়িকার মুখ আঁকলে পরে রঙ গাঢ় কইরা দিতে
হয়, নাইলে পরে তাগো ব্যাপারডা থায়ে না। আর ফাইট সিনে
হেগোরে পুরুষ মাইনসের লাহান না লাগলে হইব!’। উল্লেখ্য যে, রিক্সার নকশাতে নায়কদের অতিরিক্ত ম্যাস্কিউলিন করে তোলার ব্যাপারটা
দেখা যায়। আবার অন্যদিকে নায়িকাদের স্ফীত দেহভঙ্গিও লক্ষ্যনীয়।
তবে অনেক রিক্সা নকশাকারি কারও
মুখাবয়ব আঁকতে চান না। এমনই এক নকশাকারি হলেন মোহম্মদ আলী। তিনি মনে করেন যে
রিক্সায় কোন জীবিত বা মৃত মানুষের মুখ আঁকা একধরণের পাপ। তিনি এও মনে করিয়ে দেন যে
এই কাজ ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী।
অনেকে আবার পছন্দ করেন শহরের দৃশ্য
আঁকতে। অনেকে আবার মজে থাকেন গ্রামের ছবিতে। কিছু কিছু রিক্সাতে আবার অনেক
ক্ষেত্রে রঙের প্রলেপ না থাকলেও কাপড় ডিজাইন করে কেটে নানান মটিফ তৈরী করা হয়।
আবার বেশ কিছু রিক্সাতে দেখা মেলে
রিক্সা মালিক বা কারিগরের ফোন নাম্বার সহ নাম। উল্লেখ্য বিষয় যে, রিক্সা তৈরির কারিগরেরা তাদের নাম
বেশ জাঁকিয়ে লিখে রাখেন রিক্সার গায়ে। শুধু রিক্সার
গায়েই নয় বরং পা রাখার জায়গাটাতেও রয়েছে নকশা।
রিক্সার এই নকশাগুলোতে মিশে থাকে
কারিগরের জীবনের কথাই। তাদের জীবন সংগ্রামের কথা উঠে আসে তাদের কাজের ভিতর দিয়ে।
এই কাজগুলো পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের চিন্তা জগতের সাথে, তাদের আকাঙ্ক্ষার সাথে। শহরের দৃশ্য
আঁকা লোকটি এই ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে খুঁজে পেতে চায় তার মাথা গোঁজার ঠাই। অন্যদিকে
গ্রামের দৃশ্যের শিল্পীর মন টানে তার দেশে ফেলে আসা পরিবারের জন্য। দেশের নানান
প্রান্ত থেকে এসে জমা হয় নগরের কেন্দ্রে। পাশবিক এই শহুরে জীবনের মাঝেও তারা খুঁজে
পেতে চায় জীবনকে।
রিক্সার নকশাকে শুধুমাত্র নকশা বললে
ভুল হবে। এটি আসলে এক প্রকার প্রকাশ মাধ্যম। একেও শিল্পের আঙ্গিনায় ফেলা যায়। হয়ত
কুলীন বংশের খেতাব মিলবে না কিন্তু 'আর্ট ফর আর্ট সেক'- এমন জায়গা থেকেও তাকে রাখা
যেতেই পারে। এই প্রকাশ কারিগরের জীবনের। এই ক্যানভাসেই তারা রচনা করে তাদের
আনন্দ-বেদনার কাব্য।
কিন্তু সেই কাব্যের দাম তো মেলে না।
ছোটলোকের শিল্প হয়েই থাকতে হচ্ছে। বুর্জোয়া সমাজে তার স্থান হচ্ছে পয়সাপতিদের বসার
ঘরে। চারপাশে দামী ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। কারও ঘরের পেরেকে ঝুলে থাকে রিক্সার নক্সা
অলংকৃত টিন। অনেকে আবার নিজেদের ঘরের দেয়াল, আসবাব সাজান এই নকশাতে। রিক্সার এই নকশা এখন তাই বড়লোক আর মধ্যবিত্তের
ঘরের শোভাবর্ধনকারী দ্রব্য মাত্র। কিন্তু এতে করে কি পূর্ণ মর্যাদা পেল এই
শিল্পিরা? নিজেরা সেই আধপেটাই থেকে যাচ্ছেন। তাদের ঘরে
এখনো কান্নার রোল। তাদের বেঁচে থাকার সম্বল এখন ‘রিক্সা
আর্ট’ নামে বিশ্বময় ঘুরছে তার তাদের ভাগ্যের চাকা এখনও
একচুলও নড়ল না।